সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা অসংখ্য নারী শ্রমিক সে-দেশের বিভিন্ন মালিকের কাছে নির্যাতিত হওয়ার কথা আমরা হরহামেশাই শুনে থাকি, দেখেও থাকি। এসব তো নতুন নয়! শুরু থেকেই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমনটি হচ্ছে, তবুও পরিবারের অসচ্ছলতার কথা ভেবে আরও অনেক ব্যক্তিগত আত্মত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে এ মরণঝুঁকি আমাদের দরিদ্র নারীরা নিয়েই চলেছেন। কখনো কখনো কেউ পরিবারের চাপে বিদেশে যেতে বাধ্যও হয়, আবার ফিরেও আসে।
দুঃস্বপ্নের দিনগুলোর সমাপ্তি ঘটিয়ে; চুকিয়ে যান জীবনের অনেক মূল্য। অনেক নারী শ্রমিক অভিযোগ জানিয়ে থাকেন জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে। এজেন্সি হোক বা দালাল, নারী হোক বা পুরুষ, কেউই কি পারছেন প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের মালিকদের করা নির্যাতন প্রতিরোধ বা প্রতিকার করতে? সৌদি আরব যেতেও নিশ্চয়ই ঋণ নিতে হয় এ-সব নারী শ্রমিকদের,যোগ হয়েছে মানসিক আঘাত ও সামাজিক চাপ ও পারিবারিক সন্দেহ!
আজকের এ লেখা অত্যাচার বা নিপীড়ন রোধে যদি একটু সহায়ক হয় তবে নিজেকে ধন্য মনে করবো, আমি কাজ করছিলাম আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ইউনিটি ফর ইউনিভার্স হিউম্যান রাইটস অফ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের পক্ষে এই সংস্থার কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও একজন সাংবাদিক হিসেবে, বস্তুত অত্যাচারিত এসব নারী শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক পুনর্বাসনের অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে। সৌদি আরবে কর্মরত অসংখ্য নারী শ্রমিকের ওপরে ঠিক কী কী কারণে বাংলাদেশের নারীরা শ্রমিক হিসাবে প্রবাসে যায় ও চরম কষ্ট পেয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে ফিরে আসে?
১. ব্রাহ্মণবাড়িয়া সানজিদা আক্তার অভাবের সংসারে সচ্ছলতার আশায় গ্রামের এক পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে সুদে টাকা ধার করে সৌদিতে আসেন। কিন্তু আসার পর তাকে বাড়ির লোকের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়না। যে বাসায় সে কাজ করে,সেখানে পরিবার প্রধান একজন মহিলা, যিনি খুব কর্কট স্বভাবের প্রায় সময়ই তিনি গালাগালি করেন আর খেতেও দেন না ঠিকমতো। এইখানে সানজিদা নিয়মিত বেতন পাইনা, ন্যূনতম ভুলের জন্য মাঝে মাঝে মার খেতে হয় তাকে। তবুও ঋণের কথা মনে করেই সে প্রতিদিন ১৫-১৮ ঘণ্টা কষ্ট করে ঘরের সব কাজ করে। বাড়িতে সব কথা জানানোর পরও তার পরিবারের সবাই কিছুই করতে পারেনা একপ্রকার অসহায়। এ-তো এক গৃহকর্মী সানজিদা আক্তার, এরকম হাজার হাজার বাংলাদেশী নারী গৃহকর্মীদের গল্প এমন-ই, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জেনে থাকি। এ-তো গেলো সানজিদাদের সামান্য দুঃখ দুর্দশার গল্প, যারা সরাসরি গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে তাদের অনেকে যৌন হয়রানির শিকারও হয়, কেউ এই যৌন হয়রানির কথা বলে, আবার কেউ চুপিয়ে যাই।
২.চাঁদপুর এর রহিমা ২০ ঘন্টা কাজ করেও সময়মতো খানা,বেতন না পাওয়া এবং শারীরিক মানষিক নির্যাতন সহ করতে না পেরে সেই বন্দি দশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বেড়াই, মাঝে মাঝে কোনভাবে বাসার আসেপাশে দোকানে মালিকের বউয়ের জন্য কিছু কিনতে আসলে নিজ দেশের (বাংলাদেশ) ভাইদের সাথে একটু কষ্টের কথা গুলো শেয়ার করতে চাইলেও পারে না।
৩. নোয়াখালীর আবদুল আজিজ ও মনোয়ারার মেয়ে পারভীন (ছদ্মনাম)। অভাবের সংসারে সচ্ছলতার আশায় স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা ঋণ করে সৌদির ভিসা নিয়ে সৌদি আরব আসেন। আইনমতে ২৫ বছরের নিচে কোনো মহিলা কর্মী প্রবাসে যেতে নিষেধ। তাই ১৬ বছর বয়সি পারভিন পাসপোর্টে ২৫ বছর বয়স দেখিয়ে সৌদিতে আসে। সৌদিতে আসার পরে পারভীনকে তার মালিক যৌন হয়রানি করার চেষ্টা করে ও মালিকের যৌন প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় একটানা চার দিন তাকে খেতে দেওয়া হয়নি।
হঠাৎই একদিন সিঁড়িতে মালিক তাকে পথ আটকিয়ে যৌন হয়রানি করে। ভয়ে কাউকেই পারভীন সে কথা বলতে সাহস পাইনি। পারভীন জানায়, মালিকের বউ এবং স্কুলপড়ুয়া ছোট ছেলের অনুপস্থিতিতে মালিক তাকে যৌন হয়রানি করত। সেখানে যাওয়ার পরপরই তার কাছে থাকা পাসপোর্ট রেখে দেওয়া হয়েছে। বাসায় ঘর পরিষ্কার, কাপড় ধোয়া, সবজি কাটা, রান্না করা মিলিয়ে প্রায় ১৮ ঘণ্টাই তাকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হতো, কিন্তু সে অনুযায়ী সে খাবার পেত না। একদিন সুযোগ বুঝে ছাদের পাইপ বেয়ে সে রাস্তায় নেমে পড়ে। তখন পর্যন্ত তার তিন মাসের বেতন বাকি ছিল, যা সে পায়নি। এক ধরনের কপর্দকহীন অবস্থায় পারভীন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এবং চার মাস পর আউট পাশ দিয়ে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
এমন অনেক হৃদয়বিদারক করুন কাহিনী আমাদের বাংলাদেশী মহিলা শ্রমিকদের মুখ থেকে অহরহ শোনা যায়, কেউ এমন পরিস্থিতি থেকে বেঁচে বাড়িতে ফিরে আবার কেউ এমন পরিস্থিতি থেকে ফেরা সম্ভব না হলে নিজেকে এই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়! আমাদের দেশ শুধু কয়টা টাকা রেমিটেন্স পাওয়ার আশায় আমাদের মা-বোনদের বিদেশে পাঠিয়ে দিলেই হলো, তাদের আর কোন খোঁজ খবর নেওয়া তো দূরের কথা এমনকি বিপদে তারা ফোন করতে পারবে ফোন করে বাংলাদেশ এম্বাসি থেকে সাহায্য সহযোগিতা নিতে পারবে সেজন্য তাদেরকে মোবাইল নাম্বার পর্যন্ত দেওয়া হয় না! একটা মোবাইল তাদের হাতে দেওয়া ও সেই মোবাইল ব্যবহারের সুযোগ টুকু পর্যন্ত সৌদি আরবের কোন মালিকের কাছ থেকে নিয়ে দিতে পারে না! অথচ এদেশে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা আরো যত গৃহকর্মী আছে তারা সবাই এমন সুযোগ পায় বলে তাদের উপর এমন নির্যাতন নিপীড়ন করা অসম্ভব, কারণ তারা সাথে সাথে তাদের এম্বাসিতে এবং দেশে জানিয়ে দিতে পারে। যেটা আমাদের বাঙালিদের বেলায় প্রায় অসম্ভব! অনেক বাঙালি গৃহকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের কাছে যদি ফিলিপাইনের গৃহকর্মীদের মতো অ্যাম্বাসির মোবাইল নাম্বার দেশের এজেন্সির মোবাইল নাম্বার এবং তাদের হাতে একটা মোবাইল এবং সিম ব্যবহার করার অনুমতি নিয়ে তাদের হাতে দেওয়া যেত, তাহলে এমন নির্যাতন নিপীড়ন কমিয়ে আনা সম্ভব হতো।
লেখকঃ সাংবাদিক ও মানবাধিকার নেতা –
মোঃ দিদারুল আলম (দিদার)