চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুত বেড়েই চলেছে। গত দু’মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নারী-পুরুষ ও এক শিশুসহ পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সীতাকুণ্ড উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত ভর্তি হচ্ছেন ফৌজদারহাটস্হ "বিআইটিআইডি" হাসপাতাল, নগরীর শিশু হাসপাতাল, চমেক হাসপাতাল সহ বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে।
উপজেলা জুড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও ডেঙ্গু মশা নিধনের কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা উপজেলা প্রশাসন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কয়েকটি এলাকায় সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হলেও ডেঙ্গু মশা নিধনে গৃহীত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় উপজেলার প্রতিটি এলাকায় ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে আতংকে দিনাতিপাত করছে সীতাকুণ্ডের প্রতিটি মানুষ।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে,গত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাড়বকুণ্ডের মোঃ হোসেন ওরফে মাসুদ।
একই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের 'আইসিইউ'তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের অলিনগর এলাকার দিদারুল আলমের স্ত্রী রাবেয়া সুলতানা ওরফে মুক্তা (৩৫) এর আগে গত ৩ সেপ্টেম্বর রাতে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের 'আইসিইউ'তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা জান সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী ইউনিয়নের খাদেমপাড়া এলাকার জানে আলমের স্ত্রী বিবি আলমাস (৩৫) তিনি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।
এছাড়া ২৫ আগষ্ট ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নের সোনার পাড়া এলাকার বাসিন্দা তাজুল ইসলামের সাত মাস বয়সী পুত্র মুনতাসির।
সর্বশেষ গত ১৪ জুলাই আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ডেঙ্গু আক্রান্ত গৃহবধূ টুম্পা রানী নাথ (৩২) টুম্পা সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাইছড়ি এলাকার বাসিন্দা।
"বিআইটিআইডি" হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা.মামুনুর রশিদ বলেন,এখানে হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর জন্য ২০ টি শয্যা থাকলেও বর্তমানে তাঁর চেয়ে দ্বিগুন রোগী ভর্তি রয়েছে। যার কারণে চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
চলতি বছরে জানুয়ারী থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত এক হাজার ১৩৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়েছে। যার মধ্যে চলতি অক্টোবর মাসের ১৫ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৯০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী।
এছাড়া জুলাই মাসে ৪০৮ জন ও আগস্ট মাসে ৪১৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সেবা শেষে বাড়ি ফিরে যান।
ডা.মামুনুর রশিদ আরো বলেন,নির্দিষ্ট শয্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হওয়ায় চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। আক্রান্ত রোগীদের শরীরে তীব্র ব্যথা ও জ্বর রয়েছে। আক্রান্ত রোগীদের সবার শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যায়। পাশাপাশি রয়েছে বমি ও তীব্র পেটব্যথা। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের তারা সুস্থ করতে সাধ্যমত চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম জেলার ১৫ টি উপজেলার মধ্যে চল্লিশ ভাগ রোগীই সীতাকুণ্ডের। চলতি বছরে হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে সিংহভাগ রোগী এসেছে কুমিরা ইউনিয়নের বিভিন্ন পাড়া থেকে। এলাকাটি বর্তমানে সীতাকুণ্ডের ডেঙ্গুর হটস্পট হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। এলাকায় ডেঙ্গু মশা রেশ (লালচে দাগ) নিধনে জনপ্রতিনিধিরা যদি নজর না দেন তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশই আরো বাড়তে থাকবে। তবে সীতাকুণ্ড ছাড়াও চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর,উত্তর কাট্টলী থেকেও রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি হচ্ছে।
ডা.মামুনুর রশিদ আরো বলেন, সবচেয়ে ভয়ের বিষয়টি হচ্ছে,গত দুই সপ্তাহ ধরে আসা রোগীদের ২০ শতাংশ রোগীর গায়ে রেশ (লালচে দাগ) রয়েছে। মোট রোগীর বেশিরভাগের রক্তে প্লাটিলেট কম (৫০ হাজার থেকে এক লাখ) নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। যেখানে স্বাভাবিক মানুষের রক্তে প্লাটিলেট থাকার কথা এক লাখ ৫০ হাজার ইউনিট। অথচ কোন কোন রোগীর রক্তের প্লাটিলেট ৫০ হাজারেরও কম দেখা গেছে।
যদি কোন রোগীর প্লাটিলেট ১০ হাজার ইউনিটের নিচে চলে আসে, সে ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে রোগীকে রক্ত দিতে হয়। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো রোগীকে নতুন করে প্লাটিলেট দিতে হয়নি। চিকিৎসার মাধ্যমে তারা দুই একদিনের মধ্যেই পুনরায় প্লাটিলেট বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.নুর উদ্দিন রাশেদ বলেন, গত একমাসে হাসপাতালের বহিঃ বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা ৯৮ জন রোগীর রক্তের নমুনা পরীক্ষায় ২৫ জনের ডেঙ্গু সনাক্ত হয়েছে। হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হওয়া ৮ জন রোগীর মধ্যে চিকিৎসা সেবা নিয়ে ৩ জন গত রবিবার সকালে বাড়ি ফিরে গেছেন। বর্তমানে ৫ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে।
বাড়বকুন্ড ইউপি চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্যাহ বেলেন, এই ইউনিয়নে ডেঙ্গুতে দুইজন মারা গেছে, আক্রান্ত রোগী অনেক, ডেঙ্গু মশা নিধনে একদিকে যেমন নেই সরকারি কোনো বরাদ্দ,অন্যদিকে তেমনি নেই পরিষদের নিজস্ব ফান্ড। তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ ঠেকাতে গতকাল রবিবারে ইউপি সদস্যদের নিয়ে তিনি জরুরী সভা করেছেন।
তাঁর নিজস্ব অর্থায়নে মশক নিধনের প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনে ইউপি সদস্যদের নিযে টানা তিন দিন পুরো ইউনিয়ন জুড়ে মশক নিধন কার্যক্রম চালানো হয়েছে। সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন এলাকায় ডেঙ্গু রোগ নিয়ে মানুষ চরম আতংকে দিনাতিপাত করছে। শীঘ্রই এর কোনো প্রতিকার করতে না পারলে এটি মহামারী আকার ধারণ করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।