পানিপথের প্রথম যুদ্ধ। তারিখটা ১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিল। জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবরের কাছে পরাজিত হলেন দিল্লির শাসক ইব্রাহিম লোদি। শুরু হলো ভারতে মুঘলদের রাজত্ব। এর ঠিক বছর দুয়েক পরে অযোধ্যায় নির্মিত হলো একটি মসজিদ। তৈরি করলেন বাবরের অন্যতম সেনাপতি মীর বাঁকি। আর এই সেই অযোধ্যা, যা রামায়নে ভগবান রামচন্দ্রের জন্মভূমি বলে পরিচিত।
প্রায় চার শ বছর এভাবেই চলল। মসজিদে নামাজের পাশাপাশি পাশের চবুতরায় চলতো পূজাপাঠ, কীর্তন সবই। কোনো অসুবিধাই হয়নি। অযোধ্যায় মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ তৈরি করেনি এ ঘটনা। তবে কবে যে এই মসজিদের নাম বাবরি মসজিদ হলো তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। তবে প্রচলিত বিশ্বাসগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় হলো, প্রতিষ্ঠাতা মীর বাঁকি তাঁর সম্রাটের নামেই এই মসজিদের নামকরণ করেছিলেন।
গোলমালের সূত্রপাত ১৮৫৩ সালে। তখন দিল্লিতে মুঘল শাসন টিমটিম করে জ্বলছে। অনেকটা ব্রিটিশদের দয়ায়। নিজের মতো করে এলাকার ইতিহাস রচনায় ততদিনে দক্ষ হয়ে উঠেছে ইংরেজ। এই সময় প্রথম স্থানীয় হিন্দু জনগোষ্ঠী থেকে দাবি করা হলো, বাবরের আমলে মন্দির ভেঙে সেই জায়গায় মসজিদ তৈরি হয়েছে।
এর মধ্যে শুরু হলো সিপাহী বিদ্রোহ, যা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে পরিচিত। এই বিদ্রোহ বা সংগ্রাম দমন করার পরে ১৮৫৯ সালে বাবরি মসজিদের চারপাশে বেড়া দিয়ে দিল ব্রিটিশরা। নিয়ম করল, মুসলমানরা মসজিদে নামাজ পড়বে। আর হিন্দুরা বেড়ার বাইরে থেকে পূজা করতে পারবে।
এভাবেই চলল ৯০ বছর। ততদিনে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের গায়ে বিতর্কের লেবেল লেগে গেছে। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া ভারত স্বাধীন হওয়ার দুবছর পর ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর গভীর রাতে মসজিদের ভেতরে রাম ও সীতার পুতুল সদৃশ মূর্তি রেখে এলেন জনৈক হিন্দু পুরোহিত। এই ঘটনায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও উপ প্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। নির্দেশ দিলেন মূর্তি সরানোর। কিন্তু স্থানীয় ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেটের একক সিদ্ধান্তে মানা হলো না প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ। শেষমেষ বিতর্ক এড়াতে মসজিদে তালা ঝুলিয়ে দিল সরকার। বন্ধ হয়ে গেল নামাজ।
১৯৫০ সালে রামের পূজা ও মূর্তি স্থাপনের জন্য ফৈজাবাদের আদালতে দেওয়ানি মামলা হলো। ১৯৬১ সালে মূর্তি অপসারণ ও মসজিদের অধিকার ফিরে পেতে আদালতে দ্বারস্থ হয় সুন্নী ওয়াকফ বোর্ড। ১১ বছরে এ নিয়ে চারটি মামলা হয়, যা চলতে থাকে বছরের পর বছর।
১৯৮৬ সালে আদালত বন্ধ তালা খোলার কথা বলে। এর সাথে তাল মিলিয়ে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার মসজিদের তালা খোলার নির্দেশ দেয়।
১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধী অযোধ্যা থেকে তাঁর নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন। কিন্তু খুব দ্রুত মসজিদ–মন্দির ইস্যুতে কংগ্রেসের পালের বাতাস কেড়ে নেয় বিজেপি।
১৯৯০ সালে বিজেপির তৎকালীন সভাপতি লালকৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির বানানোর দাবিতে শুরু হয় রথযাত্রা। গুজরাট থেকে শুরু হয়ে ৬ হাজার কিলেোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সেই রথযাত্রার অযোধ্যায় এসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিহারের সমস্তিপুরে আদভানিকে গ্রেপ্তার করে লালুপ্রসাদ যাদবের সরকার।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভূমি পূজার নাম করে বিজেপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মী ও সমর্থকেরা বাবরি মসজিদের ওপরের অংশ ধ্বংস করে। নিরাপত্তা বাহিনী ছিল নির্বিকার। ঘটনার ছয় দিন পরে এর তদন্তে লিবারহান কমিশন গঠন করে দিল্লির কংগ্রেস সরকার।
২০০৩ সালে বাজপেয়ি সরকারের আমলে মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি হয়েছে কিনা, তা নিয়ে সমীক্ষা শুরু করে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
১৭ বছর পর ২০০৯ সালে লিবারহান কমিশন তার তদন্ত প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পেশ করে। এতে মসজিদ ভাঙার জন্য আরএসএসকে দায়ী করা হয়। একই সাথে আদাভানিসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র বিজেপি নেতাকে বিচারের আওতায় আনার কথা বলা হয়।
এর পরের বছর ২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট ২.৭৭ একর বিতর্কিত জমি তিনপক্ষের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়ার রায় দিলেন। এই তিন পক্ষ হলো রামলালা, সুন্নী ওয়াকফ বোর্ড ও নির্মোহী আখড়া। কিন্তু কেউই মানল না রায়, গেল সুপ্রিম কোর্টে।
সাত বছর পরে ২০১৭ সালের ২১ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট বিবাদমান সব পক্ষকে আদালতের বাইরে বিষয়টি মিটিয়ে নিতে বলেন। কিন্তু মিটমাট আর হয়নি। ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ–এর নেতৃত্বে ৫ সদস্যের বেঞ্চে এই মামলার শুনানি শুরু হয়। ওই বছরের ৬ আগস্ট থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত টানা শুনানি চলতে থাকে।
২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে বাবরি মসজিদসহ গোটা ২.৭৭ একর এলাকাকে রাম মন্দির নির্মাণের জন্য রামজন্মভূমি ট্রাস্টকে দিয়ে দেন। আর মসজিদ নির্মাণের জন্য অন্যত্র জমি দেওয়ার কথা বলা হয়। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় তখন ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ অবসর নেওয়ার পর বিজেপির সমর্থনে ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার এমপি হন।
২০২০ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অযোধ্যায় রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর লক্ষ্ণৌ হাইকোর্ট বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে আদভানিসহ সব বিজেপি নেতাকে বেকসুর খালাস দেয়।
২২ জানুয়ারি ২০২৪, অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদিও মন্দিরের কাজ এখনো শেষ হয়নি। আরও এক বছরের বেশি সময় লাগবে। তবে এর সাথে স্বাধীন ভারতের ইতিহাস নতুন বাঁক নিলো।