দেশি নিউজ ডেস্কঃ
ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নে একটি মন্দিরের প্রতিমায় আগুন ও এরপর সন্দেহের বশে ২জন কিশোর শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ১০ জনকে আটক করার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার।
তিনি গতকাল শনিবার দুপুরে জানিয়েছেন, মন্দিরটিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সন্ধ্যাবাতি দেয়া হয়েছিল। পরে প্রতিমায় আগুন ও দুইজনকে হত্যার ঘটনা ঘটে। কিন্তু আগুন কারা লাগিয়েছে সেটি জানতে তদন্ত চলছে। এ দিকে গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং নিহতদের বাড়িতে গেছেন ধর্মমন্ত্রী মো: ফরিদুল হক খান।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আগেই বিজিবি ও অতিরিক্ত পুলিশ নেয়া হয়েছে সেখানে।‘পরিস্থিতি থমথমে হলেও আমাদের নিয়ন্ত্রণে। তদন্ত চলছে, অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে’ বলছিলেন জেলা প্রশাসক। ‘এটি কোনো গণপিটুনির ঘটনা নয়, এটি পরিকল্পিত খুন। একটি রুমে কয়েকজনকে বেঁধে লাঠি, ইট ও রড দিয়ে পেটানো হয়েছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন তিনি।
নিহত দুইজন সহোদর এবং তাদের বয়স ২০ বছরেরও কম বলে জানিয়েছেন তাদের চাচাতো ভাই ইমরান খান। আহত হয়েছে আরো দু'জন। তিনি ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করেছেন। মধুখালীর পুলিশ জানিয়েছে দুইজনকে হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন যাদের আটক করা হয়েছে তারা সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের।ঘটনা সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে : জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মন্দিরে সন্ধ্যা বাতি দেয়া হয়েছিল। এর কিছুক্ষণ পর প্রতিমায় আগুন ও এর জের ধরে কয়েকজনের ওপর হামলা হলে দুইজনের মৃত্যু হয়। নিহতদের আত্মীয়স্বজন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ডুমাইন ইউনিয়নে পঞ্চপল্লী এলাকা সর্বজনীন কালীমন্দির ও এর লাগোয়াই গড়ে উঠেছে পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।মন্দির এলাকার বিবরণ দিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক পান্না বালা জানান, মন্দিরটি ছোট আকৃতির এবং এর চারদিকে দেয়াল আর ওপরে চৌচালা টিন। আর সামনে বাঁশের বেড়া দিয়ে আটকানো। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় স্থানীয়রা তাকে জানিয়েছেন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওই মন্দিরে সন্ধ্যা বাতি জ্বালানোর কাজটি করে মালতী মণ্ডল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তিনি প্রদীপ নিয়ে মন্দিরে গিয়েছিলেন।ওদিকে ওই মন্দির লাগোয়া স্কুলের শৌচাগার নির্মাণের জন্য পাশেই কয়েক দিন ধরে কাজ করছিলেন একদল শ্রমিক, যাদের বাড়িঘর অন্য এলাকায়। পুরো এলাকাটিতেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন বসবাস করেন এবং আশপাশে তেমন কোনো মুসলিম বসতি নেই। ফলে সন্ধ্যার পর প্রতিমায় আগুনের খবর স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তখন মন্দিরের পাশের স্কুলে ছিলেন নির্মাণ শ্রমিকরা। সেখানে চারজন নির্মাণ শ্রমিক, একজন রড মিস্ত্রি, একজন শ্রমিক সর্দার এবং আরেকজন নসিমন চালক ছিলেন।
সন্ধ্যার পরপরই প্রতিমায় আগুনের খবর স্থানীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে লোকজন জমায়েত করে কাছেই থাকা শ্রমিকদের ধরে নিয়ে মারধর করতে থাকে। এ সময় তারা একটি নসিমন (স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবহৃত যানবাহন) পুড়িয়ে দেয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন। কিন্তু তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে ইউএনও এবং থানার ওসিকে জানান। তারাও ঘটনাস্থলে গিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পরে আরো পুলিশ গিয়ে ফাঁকা গুলি করে শ্রমিকদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে রাতেই দুইজনের মৃত্যু হয়। সে রাতেই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার। ‘ওই ঘটনাটি (প্রতিমায় আগুন) পাশের ওই শ্রমিকদের দ্বারা হতে পারে এমন ধারণার বশবর্তী হয়েই তাদের ওপর হামলার ঘটনা হতে পারে এবং কারা হামলায় জড়িত সেটি তদন্তে বেরিয়ে আসবে,’ বলছিলেন তিনি।
এ দিকে শুক্রবার রাতেই পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, পিটিয়ে মারার ঘটনায় প্রধানত যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাকে আটক করা হয়েছে। তবে তিনি তার নাম পরিচয় প্রকাশ করেননি। ওদিকে আহত শ্রমিকদের মধ্যে দুইজনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে, জানা যায় আহতদের মধ্যে আরো দুইজন মারা গিয়েছে। এবং আরো একজন ফরিদপুরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে।
যে দুই ভাই (কিশোর) মারা গেছে তারা হলেন মধুখালীর নওপাড়া ইউনিয়নের শাজাহান খানের ছেলে আশরাফুল খান ও তার ভাই আসাদুল খান। শুক্রবার তাদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
পুলিশ সুপার শুক্রবার রাতের সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, এ ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হবে। এর একটি হবে মন্দিরে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে, দ্বিতীয়টি হবে দুইজনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে এবং তৃতীয়টি হবে পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে। নিহত দুইজনের চাচাতো ভাই ইমরান খান বলেছেন তারা চান দ্রুত যেন ঘটনার সঠিক বিচার হয়। ‘ওরা কাজ করতে গিয়েছিল। তারা আর ফিরে আসবে না। কিন্তু আমরা চাই বিচারটা যেন হয়,’ বিবিসিকে বলছিলেন তিনি।